ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

দেশে কমছেই না বাল্যবিয়ে

দেশের গ্রাম পর্যায়ে এখনো ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৫ বছরের কম বয়সে যা মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন ২০২৩ সংখ্যায় এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

 

বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ১২ দশমিক ৭ শতাংশ নারী বিধবা ও বিচ্ছেদপূর্ণ জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে বার্ষিক গড় বিয়ের হার প্রতি হাজারে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের বিয়ের গড় বয়স ২৪ বছর এবং নারীদের ১৮ দশমিক ১ বছর। বর্তমানে দেশের ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ নারীর সন্তান প্রসব হয় স্বাভাবিকভাবে এবং ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ প্রসব হয় সিজারিয়ান সেকশনে।

 

 

এর মধ্যে ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিশুর জন্মনিবন্ধন হলেও ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু থেকে যায় নিবন্ধনের বাইরে। এখনো ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ নারীর প্রসব হয় বাড়িতে, সরকারি হাসপাতালে ২৬ দশমিক ৪৩, বেসরকারি হাসপাতালে ৩৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া এনজিওতে শূন্য দশমিক ৯৯ এবং অন্যান্য মাধ্যমে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। প্রসবকালীন কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ পান—এমন মায়ের হার ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীদের গর্ভধারণের হার সবচেয়ে বেশি।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ, একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৮৫ শতাংশ হওয়া উচিত। সংস্থাটির মতে, অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। এ হার ৫ শতাংশের নিচে রাখার বিষয়ে সংস্থার পরামর্শ রয়েছে। সেই হিসাবে দেশে সিজার বা অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের হার তিন গুণের বেশি।

 

 

বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে দেশে গড় মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ২০ জন। এর মধ্যে নারী ১৭ ও পুরুষ ২২ জন। প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু হার ১৩৬ জন। তবে গ্রামে এই হার ১৫৭ এবং শহরে মাত্র ৫৬ জন। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার গড় বয়স ৭০ দশমিক ৮ এবং নারীর ক্ষেত্রে ৭৩ দশমিক ৮ বছর। প্রতি হাজারে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু মৃত্যুহার ৩৩ জন।

 

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আফরিন জাহান বলেন, বাল্যবিয়ের ফলে কিশোরী মাতৃত্বের ঝুঁকি বাড়ে, যা প্রিম্যাচিউর জন্ম, নবজাতকের কম ওজন এবং মাতৃমৃত্যুর আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এই কিশোরী মায়েরা শারীরিকভাবে পরিপূর্ণ না হওয়ায় তাদের স্বাস্থ্য ক্রমেই খারাপ হতে থাকে, বিশেষ করে পুষ্টির চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে। কারণ তাদের শরীর এবং হাড় এখনো বিকশিত হচ্ছে।

 

তিনি বলেন, বাল্যবিয়ের ফলে দীর্ঘমেয়াদে প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে, যেমন জরায়ু ক্যান্সার ও অন্যান্য প্রজনন স্বাস্থ্য জটিলতা। বাল্যবিয়ের কারণে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। কিশোরী মায়েরা উদ্বেগ, ডিপ্রেশন এবং সামাজিক চাপের শিকার হন, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

 

ডা. আফরিন বলেন, এই সমস্যার সমাধানে বহুস্তরিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে যেখানে বাল্যবিয়ের হার বেশি, সেখানে শিক্ষামূলক প্রচার এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং কিশোরী স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা উপযুক্ত পুষ্টি, শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক সহায়তা পায়। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যকার সমন্বয় নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কিশোরীদের স্বাস্থ্যসম্মত, সুরক্ষিত এবং উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 

 

 

আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্য ইমেইল

দেশে কমছেই না বাল্যবিয়ে

প্রকাশিত : ১২:০০:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

দেশের গ্রাম পর্যায়ে এখনো ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৪৪ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৫ বছরের কম বয়সে যা মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন ২০২৩ সংখ্যায় এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

 

বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ১২ দশমিক ৭ শতাংশ নারী বিধবা ও বিচ্ছেদপূর্ণ জীবন যাপন করছেন। বর্তমানে বার্ষিক গড় বিয়ের হার প্রতি হাজারে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষের বিয়ের গড় বয়স ২৪ বছর এবং নারীদের ১৮ দশমিক ১ বছর। বর্তমানে দেশের ৪৯ দশমিক ৩ শতাংশ নারীর সন্তান প্রসব হয় স্বাভাবিকভাবে এবং ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ প্রসব হয় সিজারিয়ান সেকশনে।

 

 

এর মধ্যে ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ শিশুর জন্মনিবন্ধন হলেও ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু থেকে যায় নিবন্ধনের বাইরে। এখনো ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ নারীর প্রসব হয় বাড়িতে, সরকারি হাসপাতালে ২৬ দশমিক ৪৩, বেসরকারি হাসপাতালে ৩৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া এনজিওতে শূন্য দশমিক ৯৯ এবং অন্যান্য মাধ্যমে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। প্রসবকালীন কমপক্ষে চারবার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ পান—এমন মায়ের হার ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ। দেশে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীদের গর্ভধারণের হার সবচেয়ে বেশি।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ, একটি দেশের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ৮৫ শতাংশ হওয়া উচিত। সংস্থাটির মতে, অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম ১৫ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। এ হার ৫ শতাংশের নিচে রাখার বিষয়ে সংস্থার পরামর্শ রয়েছে। সেই হিসাবে দেশে সিজার বা অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের হার তিন গুণের বেশি।

 

 

বুলেটিনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে দেশে গড় মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ২০ জন। এর মধ্যে নারী ১৭ ও পুরুষ ২২ জন। প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু হার ১৩৬ জন। তবে গ্রামে এই হার ১৫৭ এবং শহরে মাত্র ৫৬ জন। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার গড় বয়স ৭০ দশমিক ৮ এবং নারীর ক্ষেত্রে ৭৩ দশমিক ৮ বছর। প্রতি হাজারে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশু মৃত্যুহার ৩৩ জন।

 

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আফরিন জাহান বলেন, বাল্যবিয়ের ফলে কিশোরী মাতৃত্বের ঝুঁকি বাড়ে, যা প্রিম্যাচিউর জন্ম, নবজাতকের কম ওজন এবং মাতৃমৃত্যুর আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। এই কিশোরী মায়েরা শারীরিকভাবে পরিপূর্ণ না হওয়ায় তাদের স্বাস্থ্য ক্রমেই খারাপ হতে থাকে, বিশেষ করে পুষ্টির চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে। কারণ তাদের শরীর এবং হাড় এখনো বিকশিত হচ্ছে।

 

তিনি বলেন, বাল্যবিয়ের ফলে দীর্ঘমেয়াদে প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে, যেমন জরায়ু ক্যান্সার ও অন্যান্য প্রজনন স্বাস্থ্য জটিলতা। বাল্যবিয়ের কারণে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। কিশোরী মায়েরা উদ্বেগ, ডিপ্রেশন এবং সামাজিক চাপের শিকার হন, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে।

 

ডা. আফরিন বলেন, এই সমস্যার সমাধানে বহুস্তরিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে যেখানে বাল্যবিয়ের হার বেশি, সেখানে শিক্ষামূলক প্রচার এবং সচেতনতা বাড়াতে হবে। আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং কিশোরী স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা উপযুক্ত পুষ্টি, শারীরিক স্বাস্থ্য এবং মানসিক সহায়তা পায়। এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যকার সমন্বয় নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কিশোরীদের স্বাস্থ্যসম্মত, সুরক্ষিত এবং উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।