বন্যায় ফেনীতে বাড়িঘর ভেঙে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ভয়াবহ এ বন্যায় ফেনী জেলাজুড়ে প্রায় ৬৭ হাজার ২৮৭ কাঁচাপাকা ঘর, আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিক সামগ্রী পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বানভাসী মানুষের আনুমানিক ৬৯২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বসতবাড়িতে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে ঘর মেরামতে ব্যয়, আসবাবপত্রের ক্ষতি ও নিত্য ব্যবহার্য বৈদ্যুতিক সামগ্রী মেরামতের ব্যয় ভুক্তভোগীপ্রতি ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ফেনীর ছয় উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের (পিআইও) মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের দাবির ভিত্তিতে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঘরবাড়ি, জেলায় বন্যায় আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক সামগ্রীর সর্বোচ্চ ক্ষয়ক্ষতি দেখা গেছে ফুলগাজীতে। সবচেয়ে কম ক্ষয়ক্ষতি লক্ষ্য করা গেছে দাগনভূঞা এবং সোনাগাজীতে। এ দুই উপজেলায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এছাড়া ফেনী সদরের কালীদহ ইউনিয়ন, মোটবী ইউনিয়ন এবং ধর্মপুরে সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে। এ তিনটি ইউনিয়নে ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। সদর উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
ফেনী পৌর এলাকার মাস্টারপাড়া, সুলতানপুর, বারাহীপুর, সহদেবপুর, মৌলভীবাজার, একাডেমি, রামপুরসহ একাধিক আবাসিক এলাকায় এক হাজারের বেশি পানির মোটর বন্যার পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়েছে বলে মেরামতকারীদের সূত্রে জানা গেছে। শহরে বাড়িঘরে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৪০ কোটি টাকা হতে পারে বলে তথ্যে উঠে এসেছে।
ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছাগলনাইয়ার পাঁচটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় অন্তত ২০ হাজার ৫০০টি বসতঘর পানিতে তলিয়ে যায়। এতে আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০৫ কোটি টাকা বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগীরা। ক্ষতিগ্রস্ত বসতির মধ্যে দালান ঘর, সেমিপাকা, টিনশেড ও মাটির ঘর রয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বসতঘরের অন্তত ৯০ শতাংশের আসবাবপত্র বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বন্যার পানিতে পাঠাননগর ইউনিয়নে অন্তত ৫ হাজার, রাধানগর ইউনিয়নে ৫ হাজার, শুভপুর ইউনিয়নে ৩ হাজার, ঘোপাল ইউনিয়নে ৩ হাজার, পৌর এলাকায় ২ হাজার ৫০০ এবং মহামায়া ইউনিয়নে ২ হাজার বসতঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়।
পৌরসভার পশ্চিম ছাগলনাইয়া এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, বন্যায় পানির প্রবল স্রোতে ঘরের পাকা দালানের পেছনের অংশ ধসে পড়েছে। মেরামতে খরচ করতে হবে অন্তত সাড়ে ৬ লাখ টাকা।
ছাগলনাইয়া উপজেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের তথ্যমতে, সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী উপজেলার মোট ঘরের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৫৭৮টি। তারমধ্যে পাঠাননগর ইউনিয়নে ১৪ হাজার ৭৮টি, পৌরসভায় ৮ হাজার ৮৩৯টি, শুভপুর ইউনিয়নে ৭ হাজার ৩২২টি, মহামায়া ইউনিয়নে ৬ হাজার ৬৪০টি, রাধানগর ইউনিয়নে ৬ হাজার ৪৪০টি এবং ঘোপাল ইউনিয়নে মোট ঘরের সংখ্যা ৬ হাজার ২৫৯টি।
এবারের বন্যায় জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা পরশুরামে আনুমানিক ১৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলার প্রায় ২০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এতে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা।
চিথলিয়া ইউনিয়নের মধ্যম ধনীকুন্ডা এলাকার বাসিন্দা আবুল হাশেম বলেন, বন্যায় ঘরে পানি প্রবেশ করে দুটি বৈদ্যুতিক মোটর, সব আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে অন্তত আড়াই লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের উত্তর টেটেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা লোকমান হোসেন বলেন, কহুয়া নদীর পাশে বন্যার পানির তোড়ে বসতবাড়ি ভেসে গেছে। এতে প্রায় ৮ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
মির্জানগর ইউনিয়নের উত্তর মির্জানগর গ্রামের রাকিব হোসেন বলেন, ২০ আগস্ট রাতে হঠাৎ ঘরে পানি ঢুকতে শুরু করে। এক বুক পানিতে ঘর ছেড়ে প্রতিবেশীর বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পানিতে ডুবে ঘরে থাকা মোটর, ফ্রিজ ও আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। এতে প্রায় ১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
একই ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের সাইফুল ইসলাম সুমন বলেন, বন্যার পানিতে ঘরের টিন, বেড়া, টয়লেট ভেসে গেছে। আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ দেড় লাখ টাকার মতো হবে। তাদের মতো একইভাবে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা বলছেন ভুক্তভোগীরা।
২০১২ সালের জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, পরশুরাম উপজেলায় পরিবারের সংখ্যা ২৫ হাজার ৯৩৭টি।
ভয়াবহ বন্যায় ফেনীর উত্তরের জনপদ ফুলগাজীর ছয়টি ইউনিয়নে বসতঘরের সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে অনুসন্ধানে দেখা গেছে। এ উপজেলায় ২৮ হাজারেরও বেশি পরিবারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ ঘর বন্যার পানিতে ডুবে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আনুমানিক ২৪ হাজার ৭৮৭ পরিবার।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ফুলগাজী ইউনিয়নে প্রায় ৭ হাজার ৫০টি ঘর, মুন্সীরহাটে ৪ হাজার ৫৯৫টি, দরবারপুরে ৩ হাজার ৪৫৪টি, আনন্দপুরে ২ হাজার ৮২২টি, আমজাদহাটে ৪ হাজার ১৮৮টি এবং জিএমহাট ইউনিয়নে ২ হাজার ৬৮৭টি বসতঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। এ পরিবারগুলোর সব ধরনের আসবাবপত্র ব্যাপকভাবে ক্ষতি হয়েছে। ভুক্তভোগীদের তথ্য অনুযায়ী টাকার অঙ্কে ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ২৪৭ কোটি টাকা।
সরেজমিনে উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের জগতপুর, বসন্তপুর, উত্তর শ্রীপুর, ধলিয়া, ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের নিলক্ষী, গাবতলা, বাসুড়া, উত্তর ও দক্ষিণ দৌলতপুর, আমজাদহাট ইউনিয়নের উত্তর ধর্মপুর, জিএমহাট ইউনিয়নের বশিকপুর ও মুন্সীরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ শ্রীপুর, দক্ষিণ তারালিয়া, নোয়াপুর, কামাল্লা, বদরপুর, করইয়া ও পৈথারা গ্রামের বাড়িঘর দেখে বিধ্বস্ত জনপদের চিত্র ফুটে উঠেছে। পানিতে ডুবে মাটির ঘরগুলো সম্পূর্ণভাবে ভূমিতে মিশে গেছে।
ফুলগাজী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে মোট গ্রাম ৮৭টি। তার মধ্যে ফুলগাজী সদরে ২৪টি, মুন্সীরহাটে ২১, দরবারপুরে ৯, আনন্দপুরে ১৩, আমজাদহাটে ১২ ও জিএমহাট ইউনিয়নে ৮টি গ্রাম রয়েছে।
ফুলগাজী উপজেলা পরিসংখ্যান কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২২ সালের জনশুমারিতে ফুলগাজীতে মোট পরিবারের সংখ্যা ২৮ হাজার ৪৭৫টি। এসব পরিবারের মধ্যে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নে ৭ হাজার ৮৩৪টি, মুন্সীরহাট ইউনিয়নে ৫ হাজার ১৬টি, দরবারপুর ইউনিয়নে ৩ হাজার ৮৩৮টি, আনন্দপুর ইউনিয়নে ৩ হাজার ১৩৬টি, আমজাদহাট ইউনিয়নে ৫ হাজার ৫৮৫টি এবং জিএমহাট ইউনিয়নে ২ হাজার ৯৩৬টি পরিবার রয়েছে।
এ ব্যাপারে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা পেতে আবেদন করতে বলা হয়েছে।