এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণে দুই যুগেও ব্যর্থ বাংলাদেশ। গত ২৪ বছরে নিয়ন্ত্রণ দুর্বলতায় শহুরে এডিস মশার দাপট এখন দেশজুড়ে। প্রতি বছর রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিগত বছরেও যার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন আক্রান্ত ও ৫৭৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে খোদ স্বাস্থ্য বিভাগ। অথচ ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়াইয়ের ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু কীটতাত্ত্বিক পরিকল্পনা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় মশা নিয়ন্ত্রণের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে। আগামীতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিসংখ্যান বলছে, মশাবাহিত রোগের মধ্যে সারা বিশ্বে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে চিত্র উল্টো। ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও ম্যালেরিয়া অল্প কয়েকটি জেলায় সংক্রমিত হয়েছে। এ কারণে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি।
সরকারি তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ২৩ বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২ লাখ ৪৩ হাজার ১৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ৮৬৮ জনের। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের।
গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ৫৭৫ জনের। আক্রান্তের হিসাবে দেখা যায়, ৬৩ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ আর ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। ৫৭৫ জন মৃতের মধ্যে ৫১ দশমিক ১ শতাংশ নারী আর ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ।
২০২৪ সালের ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির হাসপাতালে ভর্তির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন। ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে মাসে ৬৪৪, জুনে ৭৯৮, জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯, আগস্টে ৬ হাজার ৫২১, সেপ্টেম্বরে ১৮ হাজার ৯৭, অক্টোবরে ৩০ হাজার ৮৭৯, নভেম্বরে ২৯ হাজার ৬৫২ এবং ডিসেম্বর মাসে ৯ হাজার ৭৪৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ সারা দেশর হাসপাতালে ভর্তি হয়।
বিভাগীয় হিসাবে দেখা যায়, গত বছর বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৮ হাজার ৮০১ জন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৪৫, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫ হাজার ৪০৬, ঢাকা বিভাগে ১৮ হাজার ৭৪১, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২১ হাজার ২৫৪, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৭ হাজার ৮৭৯, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে তিনজন, খুলনা বিভাগে ৯ হাজার ৯৮৮, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩ হাজার ৩৬২, রাজশাহী বিভাগে ৩ হাজার ৮৮৮, রংপুর বিভাগে ১ হাজার ৫০৯ জন এবং সিলেট বিভাগে ৩৩৮ জন।
বছরজুড়ে ডেঙ্গুতে ৫৭৫ জনের মৃত্যুর হিসাবে দেখা যায়, জানুয়ারিতে মৃত্যু হয় ভর্তি ১৬ জনের। ফেব্রুয়ারিতে ৫, মার্চে ৬, এপ্রিলে ২, মে মাসে ১২, জুনে ৮, জুলাইয়ে ১৪, আগস্টে ৩০, সেপ্টেম্বরে ৮৭, অক্টোবরে ১৩৫, নভেম্বরে ১৭৩ এবং ডিসেম্বরে ৮৭ জনের ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়।
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৫৭৫ জনের বিভাগীয় হিসেবে দেখা যায়, ২০২৪ সালে বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৬৪ জন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে এক, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৪, ঢাকা বিভাগে ৫১, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ১০৪, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২৩৯, খুলনা বিভাগে ৩৫, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৬, রাজশাহী বিভাগে আট এবং রংপুর বিভাগে তিনজনের মৃত্যু হয়।
দুই যুগের তথ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত-মৃত্যু: আক্রান্ত ও মৃত্যু দুদিক থেকে এ বছর গত দুই যুগের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০০ সালে ৫ হাজার ৫৫১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। এরপর ২০০১ সালে ২ হাজার ৪৩০ জন, ২০০২ সালে ৬ হাজার ৩৩২, ২০০৩ সালে ৪৮৬, ২০০৪ সালে ৩ হাজার ৯৩৪, ২০০৫ সালে ১ হাজার ৪৮, ২০০৬ সালে ২ হাজার ২০০, ২০০৭ সালে ৪৬৬ জন, ২০০৮ সালে ১ হাজার ১৫১, ২০০৯ সালে ৪৭২, ২০১০ সালে ৪০৯, ২০১১ সালে ১ হাজার ৩৫৯, ২০১২ সালে ৬৪১ জন, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৭৪৯, ২০১৪ সালে ৩৭৫, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ১৬২, ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৬০, ২০১৭ সালে ২ হাজার ৭৬৯, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮, ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪, ২০২০ সালে ১ হাজার ৪০৫, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯, ২০২২ সালে ৬১ হাজার ৮৯, ২০২৩ সালে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ এবং ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন।
মৃত্যুর হিসাবে দেখা গেছে, ২০০০ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৯৩ জন। এরপর ২০০১ সালে ৪৪, ২০০২ সালে ৫৮, ২০০৩ সালে ১০, ২০০৪ সালে ১৩, ২০০৫ সালে ৪, ২০০৬ সালে ১১ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়নি কারও। আবার ২০১১ সালে মৃত্যু হয় ছয়জনের। ২০১২ সালে একজন, ২০১৩ সালে দুজন, ২০১৪ সালে কারও মৃত্যু হয়নি। ২০১৫ সালে ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে আট, ২০১৮ সালে ২৬, ২০১৯ সালে ১৭৯, ২০২০ সালে সাত, ২০২১ সালে ১০৫, ২০২২ সালে ২৮১, ২০২৩ সালে ১ হাজার ৭০৫ এবং ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে প্রাণহানি ঘটে ৫৭৫ জনের।
জানা যায়, বিশ্বে ১৭৮০ সালে প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয়। এরপর ১৯৫০ সালে এশিয়ার থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়ায়। পরে ১৯৬৩ সালে ভারতের কলকাতা এবং ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশের ঢাকায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দেয়। সে সময় ডেঙ্গুকে ঢাকা ফিভার নামে অভিহিত করা হয়। ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে ডেঙ্গুকে রোগ হিসেবে দেখা হয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মো. মুশতাক হোসেন বলেন, গত দুই যুগেও ডেঙ্গু মোকাবিলায় কার্যকর উদ্যোগ গড়ে ওঠেনি। গতানুগতিক পরিকল্পনায় ডেঙ্গুর প্রকোপ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ডেঙ্গুকে জরুরি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। একটি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কীটতত্ত্ববিদের সমন্বয়ে রাজধানীসহ সারা দেশের মশা নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া দেশের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। তাহলে বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীদের ভিড় কমবে। একই সঙ্গে ঘরের কাছে রোগীরা সেবা নিতে পারবে। এতে অবহেলা অনেকটা কমে আসবে।