ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটির ‘সন্ধান’ পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। খবর আলজাজিরার।
টেলিভিশনের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, উদ্ধার ও অনুসন্ধান দলগুলো বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটির সন্ধান পেয়েছে। তবে ওই হেলিকপ্টারের আরোহী প্রেসিডেন্ট রাইসি ও অন্য কর্মকর্তাদের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
এদিকে, হেলিকপ্টারটির উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া ইরানের রেড ক্রিসেন্টের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখনও উদ্ধার অভিযান চলছে। স্থানীয় কিছু সংবাদমাধ্যম বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার খুঁজে পাওয়া গেছে বলে ‘অসমর্থিত’ তথ্য প্রকাশ করেছে।
জ্বালানিমন্ত্রী আলী আকবর মেহরাবিয়ানের বরাতে দেশটির রাষ্ট্রয়াত্ত টেলিভিশনের এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, হেলিকপ্টার খুঁজে পাওয়ার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই।
ওই সাংবাদিক বলেন, হেলিকপ্টারটি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন একটি এলাকার দুই কিলোমিটারের মধ্যে তল্লাশি ও উদ্ধারকারী দল রয়েছে।
অন্যদিকে বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার থেকে এক ফ্লাইট ক্রুর মোবাইল ফোনের সংকেত শনাক্ত করেছে সশস্ত্র বাহিনী। পূর্ব আজারবাইজানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) কমান্ডার আসগর আব্বাসঘোলিজাদেহ বলেন, আমরা এখন ওই এলাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আশা করি, জনগণকে সুসংবাদ দিতে পারব।
রোববার ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বহনকারী হেলিকপ্টারটি ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে পাহাড়ি এলাকায় বিধ্বস্ত হয়।
ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনার খবরে বলা হয়, ৬৩ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট রাইসি আজারবাইজান সীমান্তের কাছে ইরানের একটি জলাধার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ফিরছিলেন। পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের ভার্জাকন এলাকায় জরুরি অবতরণ করার সময় তাঁর হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। ঘটনাটি ঘটেছে ভার্জাকন এবং জোলফা শহরের মধ্যে ডিজমার জঙ্গলে। হেলিকপ্টারে আরও ছিলেন পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালেক রহমতি এবং সেখানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার প্রতিনিধি আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলি আলে-হাশেম। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, রাইসি ইরানের উত্তর-পশ্চিমে তাবরিজ শহরের দিকে যাচ্ছিলেন।
ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ ভাহিদি দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেন, কুয়াশাপূর্ণ আবহাওয়া ও ঘটনাস্থল দুর্গম এলাকা হওয়ায় উদ্ধার অভিযান বিলম্বিত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির হেলিকপ্টারের সঙ্গে আরও দুটি হেলিকপ্টার ছিল। এগুলো গন্তব্যে পৌঁছেছে। প্রেস টিভি জানায়, দুর্ঘটনার এক ঘণ্টা পরই উদ্ধারকারীরা ওই এলাকায় গিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। উদ্ধার কাজে একটি হেলিকপ্টার পাঠানো হলেও তা অবতরণ করতে পারেনি। সেটি ফেরত আসে। পরে অবশ্য মন্ত্রীদের নিয়ে দুটি হেলিকপ্টার সেখানে অবতরণ করে।
রাতের অন্ধকার নেমে আসায় এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে বিমানে উদ্ধার তৎপরতা স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির ইমার্জেন্সি সার্ভিস। দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভি সব নিয়মিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে সারাদেশে রাইসির জন্য প্রার্থনা দেখাচ্ছে।
ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পীর হোসেইন কলিভান্দ জানান, ছয়টি প্রদেশ থেকে ৪০টি উদ্ধারকারী দল অনুসন্ধান অভিযানে অংশ নিয়েছে। ইরানের জরুরি সেবা বিভাগ জানিয়েছে, ওই এলাকায় আটটি অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়েছে। তবে তীব্র কুয়াশায় উদ্ধারকাজ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে কয়েকটি চিকিৎসক দলও পাঠানো হয়েছে। এদিন সকালে রাইসি আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে বৈঠক করেন।
ইরানের বিমান দুর্ঘটনার ভয়ংকর রেকর্ড রয়েছে। এর অন্যতম কারণ, দেশটি বিমানের পরিষেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে পারে না। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে কোনো না কোনোভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই সময় থেকে বিমান দুর্ঘটনায় প্রায় ২০০০ ইরানি প্রাণ হারিয়েছেন।
এমন সময় এ দুর্ঘটনা ঘটল, যখন গাজা যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধংদেহী অবস্থা বিরাজ করছে। সম্প্রতি প্রথমবারের মতো ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে ইরান। ইরাক, আজারবাইজান ও পাকিস্তান এ দুর্ঘটনার খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ইরাক ও আজারবাইজান উদ্ধার তৎপরতায় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। সৌদি আরব বলেছে, রাইসির হেলিকপ্টার অনুসন্ধানে ইরানকে যে কোনো ধরনের সহায়তায় তারা প্রস্তুত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান বলেছেন, দুর্ঘটনার খবরে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত। ইরানকে সব ধরনের সহায়তা দিতে তাঁর দেশ প্রস্তুত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র বলেছেন, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে।
ইরানের বিশ্লেষক আবাস আসলানি বলেছেন, ইরানের সবাই এ দুর্ঘটনায় রাইসি এবং অন্যদের কী হয়েছে, তা শোনার জন্য উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছে। তিনি আলজাজিরাকে বলেছেন, কেউ জানে না– ঠিক কী ঘটেছে। ইরানের সংবিধানে বলা হয়েছে, হঠাৎ প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হলে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ নেতার অনুমোদন নিয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। বর্তমানে এ পদে আছেন মোহাম্মদ মোখবার।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, জনগণের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত নয়। দেশের কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। খামেনি রাষ্ট্রীয় টিভিতে প্রচারিত বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমরা আশা করি, সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের প্রিয় প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর সঙ্গীদের পূর্ণ সুস্থতায় জাতির কাছে ফিরিয়ে দেবেন।’
রাইসি ২০২১ সালের জুন থেকে ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মধ্যপন্থি হোসেইন রুহানির স্থলাভিষিক্ত হন। এএফপি জানায়, দুর্ঘটনার আগে জলাধার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে রাইসি ফিলিস্তিনের প্রতি ইরানের দৃঢ় সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তাঁকে ইরানের পরবর্তী সুপ্রিম লিডার বলে মনে করা হয়।
১৯৬০ সালে ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পবিত্র শহর মাশাদে রাইসির জন্ম। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি কারাজ শহরের প্রসিকিউটর জেনারেল হন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি তেহরানের প্রসিকিউটর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।